অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ককে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন আর সেই কবিতা আমাদের স্কুলে পাঠ্য পর্যন্ত ছিল। তিনি লিখেছিলেন ‘ওই ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল-সামাল তাই, কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই। হো হো কামাল,  তুনে কামাল কিয়া ভাই’। আজকের আধুনিক তুরস্কের উন্নয়নের যে গতি তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, আজকের তুরস্কের যতটা ভালো তা সেই কামাল আতাতুর্কের দেওয়া গতিজড়তারই ফসল। বর্তমান শাসক এরদোগান অনেক বছর যাবৎ তুরস্ককে শাসন করছেন। পৃথিবীতে অধিকাংশ শাসক যারা যতবেশি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে ততো বেশি স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হয়েছেন। ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকলে শাসকের চারপাশে চাটুকারদের ভিড় জমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এমন অবস্থা হয় যে স্তুতি ছাড়া অন্য কিছু শুনলে শত্রু মনে করে। 

বাংলাদেশ, তুরস্ক, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বেলারুশ হলো কেবল কয়েকটি উদাহরণ। অর্থাৎ এটি আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যেমন সত্য তেমনি পৃথিবীর অন্য সকল দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। ২০১৩ সাল থেকে এন্টি-গভর্নমেন্ট আন্দোলন শুরু হয় আর তখন থেকেই বিরোধী মত দমনে লেগে যান। ২০১৬ সালে একটি ব্যর্থ ক্যু হয়। সেটি দমন করতে গিয়ে অনেক মানুষ এমনকি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও চাকরিচ্যুত করেছেন, জেলে ঢুকিয়েছেন। শিক্ষা ও গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ কমিয়েছেন। শিক্ষক বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষকদের জেলে ঢুকালে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির (যেখান থেকে পদার্থবিজ্ঞানের সব চেয়ে ভালো জার্নালগুলো প্রকাশিত হয়) প্রেসিডেন্ট এইসবের প্রতিবাদে প্রতিবাদলিপি পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন।

সম্প্রতি তুরস্কের ভূমিকম্প প্রবণ জায়গাগুলোতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার বুম ঘটেছে। কর্তৃপক্ষ ওইসব জায়গায় ভূমিকম্পপ্রবণ জেনেও ভূমিকম্প সহিষ্ণু ভবন নির্মাণে তেমন কোনো চাপ দেয়নি। ফল ওসব জায়গায় প্রচুর উঁচু উঁচু ভবন নির্মিত হয়েছে। খোদ তুরস্কের সংবাদ মাধ্যমে এইসব নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলছে তুরস্ক একসময় ইউরোপিয়ান কমিশনের সদস্য হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু এরদোগানের ধর্মভিত্তিক দল এবং ঋবঃযঁষষধয এহৃষবহ-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক অনেক দেশ ভালো চোখে দেখেনি। খোদ তুরস্কেই এহৃষবহ মুভমেন্ট নিষিদ্ধ ছিল। এরদোগানের রাজনীতির পুঁজি হলো ধর্ম। ধর্মকে ব্যবহার করেই সে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করছে। যত লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকবে ততোই স্বৈরাচারী হবে। এটাই প্রকৃতিগত নিয়ম।

পৃথিবীতে যেই সরকারই ধর্ম কিংবা অন্য কোন চেতনাকে পুঁজি করে রাজনীতি করবে তার ভালো হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। বর্তমানে তুরস্ক চলছে কামাল আতাতুর্কের দেখানো উল্টো পথে। যেই আতাতুর্কের বন্দনা নজরুল করেছিলেন। আজকে তুরস্ক যেই অবস্থানে আছে তার মূলে সেই কামাল আতাতুর্ক। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়